‘তোমরা কি জানো ভোরের গোলাপ
তোমাদের ফুটে উঠার জন্য
কাল সারারাত আমিই জেগে ছিলাম !’
একটি পার্কের জন্য লড়ছি আমি,আমরা,যূথবদ্ধভাবে। প্রায় অনেক দিন ধরে। একটি অরণ্য সুন্দরী শহরে একটি শিশু পার্ক নেই ! যা ছিলো তাকেই পূর্ণাঙ্গ করার দাবী করছিলাম আমরা। অথচ কেউ শুনলনা,মানলনা। ঠিকই পার্ক জুড়ে নির্মিত হতে থাকল সুরোম্য ইট আর কংক্রিটের ভবন। অসহায় বিপন্ন গুটিকয়েক আমরা আইনের কাছে গেলাম। স্থিতিবস্থা জারী হলো। আইন চলছে তার নিজস্ব নিয়মে। জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে সময়ের চলমান বাস্তবতায়। এই বছর খানেক সময়ে অনেকখানি জানলাম বুঝলাম শুনলাম। মানুষ কত নীচে নামতে পারে–।তথাকথিত সিভিল সমাজের মগজ পঁচলে যে ঠিক কতটা বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে ,জানলাম। দেখলাম, কতটা বর্বর হতে পারে অশিক্ষিত রাজনীতিবিদ,দুর্নীতিবাজ আমলা। সাম্প্রদায়িকতার বিভৎস রূপ। প্রমাণিত হলো,মতলববাজ সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক নিজ স্বার্থে কতটা আবর্জনা মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়ায়,লাঠিয়াল হয়ে দাঁড়ায় অসৎ পুঁজিপতির। কিভাবে ভোরের সবটুকু শুভ্রতা কিনে নিতে চায় কদর্য ঠিকাদার। রাজনীতিবিদের মুখোশে কিভাবে এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে জাতিসত্তার আফিমে বুদ করে রাখে এ যুগের চাঁদ সওদাগরের দল। দেশী বেনিয়ারা কিভাবে নিলামে কিনে নেয় মানুষের চৈতন্য। কেউ ভাবেনা আগামী দিনের নাগরিকদের কথা,যারা বেড়ে উঠছে স্কুলে স্কুলে,বিনোদনহীন। ওদের শুদ্ধভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশ নিশ্চিত করবে কে ? আমাদের কারো কি কোন দায়িত্ব নেই ? আমাদের সন্তানদের বিনোদনের জন্য আমরা কি একটি পার্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারিনা আমাদের এই শহরে ? একটি পার্কের জন্য আমাদের লড়াইয়ে আপনারা যারা পাশে আছেন সরাসরি অথবা মৌনভাবে তাদের সবাইকে জানাই লাল সালাম। আজ আমরা একা,কাল ? আমাদের মিছিল বড় হবে ক্রমশঃ । যতই পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াক অশূভ মানুষের দল ,পথ থেকে সরে দাঁড়াবোনা । পারো তো সরিয়ে দাও,চিরতরে। নতুবা বেঁচে থাকতে দাও নিজের বিশুদ্ধ বিশ্বাসে। আমার পাশে থাকা স্কুলের প্রজাপতিরা -তোমরা ভালো থেকো ,বিশ্বাস রেখো ,আমার প্রতি ,আমাদের প্রতি সাধ্যের সর্বোচ্চ বিন্দু দিয়ে তোমাদের জন্য লড়ে যাবো । শুধু মনে রেখো পরবর্তী জীবনের প্রতিটি বাঁকে আর কেউই নয়- ‘তোমাদের ফুঠে উঠার জন্য সারারাত আমরাই জেগে ছিলাম———–’
‘বুঝতে পারোনি কতোখানি পরাজিত
বুঝতে পারোনি কতোখানি ভেঙে গেছি
কতটা গভীর হয়েছে আমার ক্ষত
বুঝতে পারোনি কতখানি হেরে গেছি’
ওদের ক্যাম্পাস জীবন শুরু একই বছরে। আলাদা আলাদা সাবজেক্টে । কেউ কাউকে চিনতনা।নিয়তি একদিন তাদের কাছে নিয়ে আসে। কবে ? আমার মনে নেই । ওদের হয়ত মনে আছে। কৃষ্ণচূড়ায় রাঙা পাহাড়ী ক্যাম্পাস,প্রিয় জারুলতলা,চাকসুর সেই টেবিল ,প্রীতিলতা হলের সবুজ চত্তর,ঝুপড়িতে জাহাঙ্গীরের দোকান তাদের যুগল স্রোত বয়ে গেছে কতদিন এইসব প্রান্তর জুড়ে। সে খবর কে আর রেখেছে আমরা ছাড়া। মেয়েটির এক দুঃখবতী কালে ছেলেটির সাথে সখ্য,ছেলেটিরও তখন আকাশ জুড়ে বৈশাখী ঝড়ের প্রলয়। দুইটি মানুষ আলাদা আলাদা কারণে বিষন্ন ছিলো ,ভাঙছিলো তুমুল সেই গ্রহনলাগা কালে। এর পর—-। বিন্দু বিন্দু করে যে যার মত করে গড়ে নেয় নিজস্ব জীবন। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়া আলাদা হয়না। বুকের ভেতর নিজস্ব বৃষ্টি পুষে রেখে এক অদ্ভূদ বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়ে ওরা।ক্রমশঃ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে পরস্পরের । ছেলেটিকে কী এক অফুরন্ত ভালোবাসা আর অভিবাবকত্বে গড়ে তোলে মেয়েটি। নিজেকে চিনতে পারে ছেলেটি,বুঝতে পারে নিজের সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ শক্তি। তবুও ভুল করা যুবক আবার ভুল করে বসে। মেয়েটির এতো মমতায় থেকেও এক মানবিক বেদনায় ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায় ছেলেটি তার নিজের পাহাড়ী মফস্বল শহরে। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটি পারেনা তাকে ফেরাতে।ক্যাম্পাসে ভীষণ একা হয়ে যায় মেয়েটি। তার যে নির্ভরশীলতার প্রিয় বন্ধুটি নেই ! সংগঠন, ক্লাস, কর্মসূচী নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে মেয়েটি। ক্যাম্পাসে জনপ্রিয় হয়ে উঠে নিজ যোগ্যতায়। এতো ব্যস্ততা, এতো জনপ্রিয়তা ! তবুও কেউ জানেনা বুকের ভেতর কি এক পাহাড় সমান বেদনা নিয়ে প্রতিদিন হলে ফেরে মেয়েটি। কী ভীষণ ক্ষরণ নিজের ভেতর ,কারো সাথে শেয়ার করা যায়না,যার সাথে করা যেতো সেও আজ দূর বহুদূর। নিঃসঙ্গ মেয়েটি ছেলেটিকে ভোলেনা শত ব্যস্ততায়। শুরু হয় চিঠি পর্ব । ওদিকে নিজের শহরে কবিতার প্রাসাদ গড়ে বাউন্ডুলে ছেলেটি। মেয়েটির জন্য মন কাঁদে তার। উৎকন্ঠায় ঘুম আসেনা। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে বড় ইচ্ছে করে। কিন্তু পারেনা। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে। তবু রোজ করে চিঠি লিখতে ভোলেনা। নিয়মিত চিঠি আসতে আর যেতে থাকে দুই মানব মানবীর ঠিকানায়। চিঠি জুড়ে কত বেদনা,কত হৃদয় পদ্য। শব্দের খেলায় মেতে উঠে ওরা । হৃদ্যতা বাড়ে,দেখা হয় মাঝে- মাঝে,কথা হয় প্রায়ই। ওদের বন্ধুত্ব পেরিয়ে যায় সর্বোচ্চ সীমানা। এখন ওরা বলে ওরা বন্ধু নয়,তবে ——— ? না, প্রেমিক প্রেমিকাও নয়। ওরা এখন সব মানবিক সম্পর্কের উর্ধ্বে। ভিন গ্রহচারী দুটি অবুঝ হৃদয় খুঁজে ফেরে অন্য কোন সূর্যোদয়। ( প্রিয় পাঠক,চুপি চুপি বলি – আমাকে বলে গেছে গত রাতের আকাশ ,ওরা পরস্পরকে বলে “ যদি ভালোবাসো,জেনো তার চেয়েও বেশী ভালোবাসি ”)। ওরা বেঁচে থাক,ওদের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হোক, এই হোক আমাদের শুভ কামনা।
‘আর যখন থাকেনা কিছু ,
কেউ এই বুকে
ভাঙন ভাঙন বলে ডাক দিতে বড় উচ্ছে করে-’
কখন পরিচয় তাদের সাথে ,কোন অবেলায় ? আজ আর ধূলিমাধা সেই সব স্মৃতি খুউব বেশি মনে পড়েনা। এই তো সেদিন ডাকপিয়নের হাতে থোকা থোকা মুঠো ভর্তি চিঠি এসে ঝড়ো হতো পড়ার টেবিলে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে। অদ্ভূদ সব চিঠি, বর্ণিল খাম,খেয়ালী চিঠিওয়ালী। কি থাকতো চিঠিতে ? কারো নিজস্ব বেদনা আবার কারো পারিবারিক। অজানা অচেনা এক পাহাড়ী যুবককে কী নিদ্বির্ধায় লজ্জাবতী বাঙালী মেয়ে মানবীর সারল্যে বলে যেতো নিজের যত গোপন লুকনো কথা। অচেনা পত্রমিতার দুঃখে ছেলেটির মন হুহু কেঁদে উঠত,আবার আনন্দে হাঃ হাঃ । কত দূর দূরান্তের চিঠি। গাঁয়ের চিঠি ,শহরের চিঠি। স্কুল পড়–য়া গ্রাম্য মেয়ের চিঠি,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শহুরে মেয়েদের চিঠি। কত কথা,কত বেদনা তাদের। কুমিল্লার টুম্পা,ঢাকার মেরিনা, রাজশাহীর সুমনা, ময়মনসিংহের শৈব্বা,রিনি, দিনাজপুরের অথৈ, নেত্রকোণার শায়লা,নাটোরের লাকী,ফরিদপুরের জয়া,চট্টগ্রামের রুমা ,জাবির রুমকী,সিলেট মেডিকেলের শ্রাবন্তী,চমেক এর অর্পিতা ——আরো কত শত জোনাকী— কত নাম— আজ সবাই স্মৃতি। সুন্দরতম স্মৃতি। কত জীবনের সাথে নিজ জীবনের গল্প বিনিময়। ভোরের শিশির সিক্ত শিউলির পবিত্র সুন্দর এই মেয়েগুলি আজ কে কোথায় কি জানি। অথচ এমনো তো অনেক দিন ছিলো এদের চিঠি না পেলে মাতাল হয়ে উঠতাম। বুকটা খালি খালি মনে হতো।কী আবেগ আর উচ্ছাসের সেইসব দিন। আজ পরিবর্তিত জীবনে বান্ধবীরা কেউ কেউ প্রবেশে করেছে গার্হস্থ্য জীবনে,কেউবা নতুন প্রণয়ে,কেউবা ভুল বুঝে দূরে সরে গেছে—— । সময় বড় ধূলো ফেলে সম্পর্কের উপর। তাইতো এককালের প্রিয় মুখ গুলো ক্রমশঃ ধূসর থেকে ধূসরতর,স্মৃতি সব মলিন । থোকা থোকা কষ্ট ঝরে পড়ে। একে একে স্মৃতির ঝাঁপি থেকে হারিয়ে যায় এককালের প্রিয় বান্ধবীর দল। পেছনে পড়ে কিছু সুন্দর দিনের সুন্দরতম একফালি স্মৃতি আর একজন নিঃসঙ্গ যুবক কবি অথবা কবিতার ফেরিওয়ালা।