‘মানুষ কি’ইনা পারে!’ এই আপ্তবাক্যটির আরেকবার সত্যতা পাবেন আপনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘মিরাকল গার্ডেন’-এ গেলে। ‘অবিশ্বাস্য সুন্দর’ বলে যদি কিছু থাকে পৃথিবীতে তারই একটি এই ফুলের বাগান। শুধুই কি ফুলের বাগান ! মানুষের প্রিয় নানান জাতের ফুলকে পরিপূর্ণ ব্যবহার করে কি করে আশ্চর্য্য সুন্দর ও নান্দনিক সব স্থাপনায় ভরপূর একটি বাগান তৈরি করা যায়,তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
মিরাকল গার্ডেন এর গল্প শুনেছি আমি বহুবার বহুজনের কাছে। তাই যখনই সংযুক্ত আরব আমিরাত ট্যুরের প্ল্যান করি তখনই মনে মনে ঠিক করে নিই,কোনভাবেই এই নয়নাভিরাম স্থাপনা দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। যে ভাবনা সেই কাজ। স্বপ্নের দুবাই সফরে তাই একটা দিন বরাদ্দ ছিলো মিরাকল গার্ডেনেই। সাথে ছিলো তিন বন্ধু করিম,মাসুদ ও টিটু।
যেভাবে পথ চলা শুরু মিরাকল গার্ডেনের
দুবাইল্যান্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই পার্কটি যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে এই পার্কের প্রায় ৭২ হাজার বর্গমিটার ভূমি ফুলে ফুলে ভরে থাকে। প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ফুলের এই উদ্যানটিকে যেনো মনে হয় পৃথিবীর বুকে ফুলের স্বর্গ। ইতোমধ্যেই বিশ্বের সবচে বড় ফুলের বাগান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করা এই পার্ক ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে গিনেজ রেকর্ড বুকের স্বীকৃতিও। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে পার্কটি,মূলত: প্রচন্ড গরম এবং সংস্কার কাজের জন্য।
দুর্দান্ত সব ডিজাইন আর ভাস্কর্যে ঠাসা এই উদ্যান প্রতিবছরই তার রূপ ও বৈচিত্র বদলায়। ফলে বছরজুড়ে ১.৫ মিলিয়ন দর্শনার্থীদের ভীড়ে মুখর থাকা এই উদ্যান যেনো মুগ্ধতা আর সুগন্ধের রোশনাই ছড়াচ্ছে বিগত সাতটি বছর ধরে।
কিভাবে যাবেন
সরাসরি নিজে বা পরিচিতজনের গাড়ীতে সরাসরি যেতে পারেন মিরাকল গার্ডেনে। এছাড়া লাল লাইনের দুবাই মেট্রোতে চড়ে নেমে পড়ুন মিরাকল গার্ডেনের সবচে কাছের মেট্রো স্টেশন এমওই বা মল অব দ্য এমিরেটস মেট্রো স্টেশনে। এখান থেকে ১০৫ নাম্বার উঠে পড়–ন,বাস সরাসরি আপনাকে নিয়ে যাবে মিরাকল গার্ডেনে। মাত্র ৫ দিরহাম খরচ করে ২০/২৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন সহজেই। ফেরার পথে ট্যাক্সি নিয়ে নিন এমওই বা মল অব দ্য এমিরেটস মেট্রো স্টেশন যেতে,সেখান থেকে মেট্রোতে ফিরুন নিজের আস্তানায়।
কি আছে মিরাকল গার্ডেনে !
নানান প্রজাতির ফুল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে আশ্চর্য সব স্থাপনা। এর মধ্যে আপনাকে সবচে বেশি অবাক করবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থা এমিরেটস এ৩৮০ এর ডেমো বিমান,মিকি মাউস,বিগ টেডি বিয়ার,লস্ট প্যারাডাইস,লেক পার্ক,হার্টস প্যাসেজ,ফ্লোরাল ক্লক,ফ্লোরাল ক্যাসেল,আমব্রেলা প্যাসেজ,হিল টপ,বড় কচ্ছপ। প্রতিটি স্থাপনাই নির্মাণ করা হয়েছে শুধুমাত্র জীবন্ত ফুল ব্যবহার করেই। এছাড়া বিনোদনের জন্য সেখানে রয়েছে এম্পি থিয়েটার,ট্র্যাম্বোলিন পার্ক,থিডি ম্যাপিং,সাপ্তাহিক লাইভ শো,ফ্লাওয়ার প্যারেড। আছে সুভ্যেনির শপ,ফটোবুথ,ডিজনির পণ্য বিক্রির শপ।
গিনেজ ওয়ার্ল্ড বুকে মিরাকল গার্ডেন
২০১৩ সালের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে যাত্রা শুরু করা এই পার্কটি ইতোমধ্যেই দুইবার গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্বের সবচে বড় ফুলের তৈরি এয়ারবাস এ৩৮০ এর কাঠামো তৈরির জন্য এবং ২০১৩ সালে বিশ্বের সবচে বড় উল্লম্প বাগানের জন্য। ২০১৮ সালে গার্ডেনটি বিশ্বের সবচে উঁচু ট্যপিয়ারি ভাস্কর্যের জন্যও প্রশংসিত হয়। প্রায় ১৮ মিটার উচ্চতার ডিজনীর এই ভাস্কর্যটি এক লক্ষ ফুল ও গাছপালা দিয়ে তৈরি এবং এর ওজন প্রায় ৩৫ টন।
প্রবেশ টিকেট
মিরাকল গার্ডেন এ প্রবেশের জন্য আপনাকে গুণতে হবে চড়ামূল্যের টিকেট। বয়স্কদের জন্য ৫৫ দেরহাম এবং ১২ বছরের নীচে ৩ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশু কিশোরদের জন্য ৪০ দেরহাম। ৩ বছরের নীচের শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য টিকেট ফ্রি। বন্ধের দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিন বলে সকাল ৯ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত খোলা থাকে পার্ক।
জন্মদিন,বিয়ে কিংবা কর্পোরেট মিটিং এর জন্যও আপনি চাইলে এখানে বুকিং দিতে পারবেন। তার জন্য events@dubaimiraclegarden.com এই মেইলে আগাম যোগাযোগ করতে হবে। অথবা +৯৭১ ৪ ৪২২ ৮৯০২ নাম্বারে।
একইভাবে স্কুল বা কলেজের শিক্ষাসফর কিংবা অন্য কোন স্টাডি ট্যুরের জন্য আগাম যোগাযোগ করতে হবে- booking@dubaimiraclegarden.com
পার্কের সুুবিধা সমূহ
২ হাজার গাড়ীর পার্কিং সুবিধা সম্বলিত ৬০ হাজার বর্গমিটারের বিশাল পার্কি স্পেস এর পাশাপাশি ভিআইপি পার্কিং,বসার জায়গা,প্রার্থনা কক্ষ,টয়লেট ব্লক,প্রসাধনীর ব্যবস্থা,নিরাপত্তা রুম,প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষ,প্রতিবন্ধী দর্শনার্থীদের জন্য গাড়ি,সুভ্যেনির শপ,খাবারের দোকানসহ নানান সুবিধা রয়েছে পুরো গার্ডেনজুড়েই।
ফুডকর্ণার : খাবারেও বৈচিত্র্য আর ভিন্নতার স্বাদ
ফুলের বৈচিত্র্যে বিমোহিত আপনি একসময় ক্লান্ত হবেন। ঘুরতে ঘুরতে পেটে চো চো শব্দ শুরু ! ক্ষিধে পেয়েছো তো ? টেনশন নিবেন না। পুরো পার্কজুড়েই আছে বেশ কয়েকটি খাবার দোকান। চেইনশপ পিজা হাট এর পাশাপাশি এখানে পাবেন ভারতীয় খাবারের জন্য ভোজন রেস্টুরেন্ট, আমেরিকান খাবারের জন্য হার্ডেজ,টেরিবল ইন্টারনেট। এরাবিক খাবারের জন্য আছে শর্মার জন্য বিখ্যাত আজরাত লেবনান,ফাতায়ের এবং মোহাম্মদ কুরদী। লেবানিজ খাবারের জন্য আছে সাজটুগো।
এগুলা ছাড়াও আছে বেশ কয়েকটি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ক্যাফে ও মিষ্টি বার। এগুলো হলো-ক্রিসপি ক্রিম,মিট এন্ড ইট,ক্যান্ডি শপ,কুল এন্ড কুল,মি: সুগারক্যান,প্যাশন ফ্রুট জুস,টেরিবল ইন্টারনেট,রুক আল সুন্দাস,রাসভেরি ইয়োগার্ড,আমিন,গেলাটো হাউজ এবং ডিএমজি ক্যাফে। এছাড়াও ছোট তিনটি দোকানে পাবেন পপকর্ণ,গ্রিডল কর্ণ এবং হানি নাটস।
যেসব নিয়ম মানতে হবে
১. টিকেট দেয়া হয় একবার প্রবেশের জন্যই এবং এটা অফেরতযোগ্যও।
২. পেশাদার ক্যামেরা ও ড্রোন নিয়ে প্রবেশ করা যাবেনা
৩. পেশাগত ভিডিও,বিয়ে,জন্মদিন,শ্যূটি কিংবা বিজ্ঞাপন নির্মাণের যেকোন কাজের জন্য কতৃপক্ষের আগাম অনুমতি নিতে হবে।
৪. খোলা এবং বন্ধের সময়সূচী কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
৫. ফুল ছেঁড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
৬. পোষা প্রাণী,বল কিংবা অন্যকোন খেলার সামগ্রী নিয়ে গার্ডেনে প্রবেশ করা যাবেনা
৭. বাইরের কোন খাবারও ভেতওে নেয়া যাবেনা।
৮. বারবিকিউ পার্টি অনুমোদিত নয়
৯. নির্দিষ্ট করা জায়গা ছাড়া যেখানে সেখানে বসা যাবেনা
১০. নিরাপত্তা কর্মীদের যেকোন নির্দেশনা মানতে হবে কোন প্রকার তর্কে না জড়িয়েই।
১১. পার্কের সম্পত্তি ,ফুল কিংবা দুর্ব্যবহারের জন্য পার্ক কর্তৃপক্ষ যে কাউকে তাৎক্ষনিক পার্ক থেকে বের করে দিতে পারবে
দুবাই বাটারফ্লাই গার্ডেন
২০১৫ সালে মিরাকল গার্ডেনেই সংযুক্ত হয়েছে ‘দুবাই বাটারফ্লাই গার্ডেন’। এখানে প্রবেশ পথ এবং প্রবেশমূল্য আলাদা। ৩ বছরের উপরের বয়সী যেকোন মানুষের জন্য প্রবেশ ফি ৫৫ দিরহাম। বন্ধের দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা অবধি খোলা থাকে এই গার্ডেন। পৃথিবীর সবচে বড় প্রজাপতি পার্ক হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি পাওয়া এই পার্কে ২৬ প্রজাতির ১৫ হাজার প্রজাপতি আছে। এটা পুরোটাই একটি ইনডোর গার্ডেন,যেখানে দশটি পৃথক গম্বুজ রয়েছে,যার ভেতরে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতিগুলো। সবচে মজার বিষয় হলো আপনি এখানে প্রজাপতির জীবনচক্র সম্পর্কেও সরাসরি ধারণা পাবেন, কিভাবে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বিকশিত হয় এই সুন্দর প্রাণীটি,যা বেশ শিক্ষনীয়ও বটে। প্রজাপতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে ছবি তোলারও সুযোগ পাবেন এখানে আপনি।
মিরাকল গার্ডেনের লাগোয়া এই প্রজাপতি পার্কে প্রবেশের জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তাও নিতে পারেন আপনি।
নেপথ্যে স্বপ্নবাজ একজন আবদেল নাসের রাহাল
দুবাইভিত্তিক সিটিল্যান্ড গ্রুপ এর মালিকানায় পরিচালিত হয় এই মিরাকল গার্ডেন ও প্রজাপতি পার্ক। ১২ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এই কোম্পানীতে এখন ১২০০ কর্মচারি কাজ করছে। তাদের ২২০ টি প্রকল্প চলমান এবং ইতোমধ্যেই কোম্পানী ১০০ টি দেশী বিদেশী পুরষ্কার অর্জন করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল আইন এর সবুজ প্রান্তরে এক যুগ আগে কৃষি বিজ্ঞানী আবদেল নাসের রাহাল এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানীটি এখন দেশটির অন্যতম আলোচিত একটি শিল্প গ্রুপ। এই মানুষটিই মূলত: মিরাকল গার্ডেন ও প্রজাপতি পার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও নির্মাতা। তিনি নিজে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং শেখ তারাব বিন তাহানুন বিন মোহাম্মদ নাহিয়ান গ্রুপটির চেয়ারম্যান।
অবিশ্বাস্য দ্যুতিময় এক বাগান
দুবাই বেড়াতে বা কাজে গিয়েছেন,অথচ মিরাকল গার্ডেনে যাননি, এমন মানুষ বিরল। অর্থকড়ি অনেকেরই আছে। পৃথিবীতে ধনী দেশের বা মানুষেরও অভাব নেই। কিন্তু সেই অর্থকে কে কতটা রুচিশীল উপায়ে ব্যবহার করতে পারে,তাতেই ফুটে উঠে তার আভিজাত্য আর সৌন্দর্য্য। আধুনিক শহর দুবাই বিশ্বের সকল দেশের সব নাগরিকের নি:সন্দেহে স্বপ্নের গন্তব্য। কিন্তু সেই স্বপ্নমুখী মানুষদের প্রায় সবাইকেই অনিবার্য গন্তব্য হিসেবে শুধুমাত্র একটি ফুলের বাগানমুখী করার বিষয়টি,ছোটখাটো কোন ব্যাপার নয়। একটি ফুলের পার্কের আশ্চর্য্য সুন্দর দ্যুতিময় সৌন্দর্য্য কতটা আলো ছড়াতে পারে তা সহজে অনুমেয়ই বটে !