প্রিয় বাবা
এই চিঠি যখন তোমাকে লিখছি,তখনো কক্সবাজার সীমান্ত পেরিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থীর মিছিল ঢুকছে এ দেশে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতা,একদল বৌদ্ধভিক্ষুর অমানবিকতা,নোবেলজয়ী একজন সূচীর অনৈতিক নিপিড়নের শিকার এইসব মানুষ জীবন বাঁচাতে ঠাঁই নিচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। ভূ-রাজনীতি আর ভবিষ্যত শংকায় শুরুতে বাংলাদেশ এদের স্বাগত জানায়নি,কিন্তু মানবতার আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেননি জাতির জনকের কণ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ছুটে গেছেন,আশ্রয় দিয়েছেন,শরনার্থী মর্যাদা দিয়েছেন এবং বিশ্বের দরবারে সবার সাথে এইসব বিপন্ন মানুষের জন্য কথা বলছেন,লড়ছেন। বাবা,তুমি অবাক হয়ে যাবে কি নৃশংস বর্বরতা চালাচ্ছে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের উপর সেদেশের সরকার ও বৌদ্ধ মৌলবাদীরা। শত শত নারীকে ধর্ষন,শিশুদের আঁছড়ে মারা,পুরুষদের জঘণ্য ও নির্মম হত্যার মধ্য দিয়ে যে বর্বরতা মিয়ানমার সরকার দেখিয়েছে,তা সভ্য পৃথিবীর জন্য কলংকই বটে। রোহিঙ্গারা ইসলামে ধর্মের অনুসারি হলেও সেখানকার বৌদ্ধ রাখাইন আর মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরোধে বহুদিনের পুরনো। সেই বিরোধে বারবার মার খেয়েছে দুর্বল রোহিঙ্গারা,নিজের দেশেই আশ্রয়হীন বিপন্ন হচ্ছে তারা দিনে দিনে। শুরুতে কেউই ছিলোনা তাদের পাশে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং বাংলাদেশ সরকারই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে,কেনো বিশ্বের বুকে এখনো মানবিকতার এক অসাধারণ উদাহরণ এই দেশ।
জানো বাবা, এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কালেও একমত হতে পারেনি আমাদের দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলো। পরস্পরের দিকে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করছে রাজনীতিবিদরা আর জনগণের একটা অংশ রোহিঙ্গা নিপিড়নের সাথে ধর্মকে তালগোল পাকিয়ে এ দেশে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগকে ব্যবহার করতে ভূয়া ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকের মাধ্যমে নানাভাবে উস্কানি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। দেশের কয়েকটি স্থানে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও এই ধর্মের অনুসারিদের উপর হামলা এবং হামলার চেষ্টা হয়েছে। খোদ পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় এবং যশোরের বেনাপোলে দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর উপর হামলা জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করেছে। এনিয়ে বিব্রত সরকার,প্রগতিশীল বিবেকবান মানুষ । অন্যদিকে শংকিত সংখ্যালঘুরা। কিন্তু এসব রুখবে কে ? সরকার একাই চেষ্টা করে যাচ্ছে,চেষ্টা করছেন সব ধর্মের সুস্থ চিন্তার মানুষেরা। জাতি ধর্ম বর্ণের মানুষেরাও রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে সামিল হয়েছে সারাদেশে নানান কর্মসূচীতে। এমনিক এবার প্রবারণায় ফানুস না উড়িয়ে মিয়ানমারে জাতিগত নিপিড়নের প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এদেশের বৌদ্ধরা। তবুও থেমে নেই উগ্র মৌলবাদীরা। দেশের নানান প্রান্ত থেকেই সংখ্যালঘুদের কটুক্তি এবং ভয় দেখানোর খবর পাচ্ছি গণমাধ্যমে,যদিও এর অনেকগুলোই গুজব। এসবে পিছিয়ে নেই প্রধান দল কিংবা বিরোধী দল,কেউই। তবে সরকার কঠোর হাতেই নিয়ন্ত্রন করছে পুরো পরিস্থিতি। আমারও কেনো জানি বিশ্বাস হয়,সরকার খারাপ কিছুই হতে দেবেনা। নিরাপদ থাকবে প্রিয় স্বদেশ আমার।
বাবা,
রাজনীতির কথা অনেক তো হলো,এবার তোমায় রাঙামাটির গল্প বলি। তুমিতো জানোই না,এবছর টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে তোমার প্রিয় প্রিয় শহর রাঙামাটি এবং কাপ্তাই,কাউখালি,জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকও ছিলেন ৫ জন । শুধু কি তাই ? বসতবাড়ি হারিয়ে নি:স্ব হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। আহত হয়েছেন প্রায় দুইশত মানুষ। পঙ্গু হয়েছেন কেউ কেউ। টানা প্রায় তিনমাস শহরের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলো কয়েক হাজার মানুষ। কি বিশ্বাস হচ্ছেনা তোমার ? হুম বাবা, আমারও বিশ্বাস হয়নি। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনে আমিও বিশ্বাস করিনি বাবা,কেউই বিশ্বাস করেনি। প্রিয় পাহাড়গুলো এমন আগ্রাসি হয়ে উঠবে কেইবা জানতো ! কি ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় যে হয়েছিলো। জুন মাসের ১২ ও ১৩ তারিখ সংঘটিত হওয়া এই মহাবিপর্যয়ে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুরো রাঙামাটি জেলা। বন্ধ হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। বিদ্যুৎহীন ছিলো শহর টানা পাঁচদিন। জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট,খাবার পানি আর পণ্যের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিলো। এ যেনো যুদ্ধ পরিস্থিতি। কিন্তু কি আশ্চর্য্য,সব ভেদাভেদ ভুলে রাঙামাটিবাসি ঐক্য আর সংহতির চেতনাকে বুকে ধারণ করে সেদিন এই ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে তুমি ভাবতেও পারবেনা। পাড়ার সবচে দুষ্ট ছেলেটা,ঘরকুনো মেয়েটা, সবাই দিনের পর দিন আশ্রয়কেন্দ্রে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে মানবিকতা কি জিনিস ! রাঙামাটিবাসি সেদিন সেদিন নতুন করে চিনেছে নিজেদের,নিজেদের সন্তানদের। এ যেনো এক চেনা জনপদে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত লড়াই। হ্যাঁ, বাবা, শোনে- তুমি যে অফিসে চাকুরি করতে আমৃত্যু সেই তোমার ডিসি অফিসের যিনি প্রধান,জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান এবং তোমার সহকর্মীরা সবাই দিনরাত কি কষ্ট আর পরিশ্রম যে করেছে,তুমি অবাক হয়ে যেতে দেখলে। সাংবাদিক হিসেবেই কাছ থেকে দেখেছি আমি সব। আমি জানি,তুমি থাকলে তুমিও ঝাঁপিয়ে পড়তে সহকর্মীদের সাথে। কিন্তু…..
বাবা,তুমি নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ভাবছো,হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো কেনো রাঙামাটির সব পাহাড় ! শোনো,পাহাড় ক্ষেপেছে নানা কারণেই। সবাই যত্রতত্র বাড়ী বানাতে যেভাবে কেটে কেটে পাহাড়ের বুকে গভীর ক্ষত বানিয়েছে,তার শোধ তো সে নেবেই। তবে আরও কিছু কারণতো আছেই। এই যেমন ধরো,বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ের বুকে সেগুণ আর আনারস চাষ পাহাড়ের উপরের মাটির গাঁথুনিকে দুর্বল করেছে, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে। আবার এখানকার মাটি যে বেলে দোঁআশ মাটি,দেখতে শক্ত কিন্তু টানা বৃষ্টিতে গাঁথুনি ছেড়ে আলগা হয়ে যায়। ফলে গত দশ বছরের মধ্যে সবচে বেশি বৃষ্টির আঘাত সইতে পারেনি এই মাটি। মজার ব্যাপার কি জানো বাবা, শুধু কাটা পাহাড়ই নয়,একদম ভার্জিন পাহাড়,যেখানে কখনো মাটিই কাটা হয়নি,এমন পাহাড়ও ধসে পড়েছে এবার। এনিয়ে বিশেষজ্ঞরাও উদ্বিগ্ন। পাহাড়ের আচরণে অবাক তারাও। চলছে নানান বিশ্লেষন। গঠিত হয়েছে জাতীয় পর্যায়ের কমিটিও।
তুমি মন খারাপ করোনা বাবা, যারা মারা গেছেন তাদের জন্য দোয়া করো। আর আমাদের জন্যও দোয়া করো,যেনো এমন মানবিক বিপর্যয় আর কখনই পার্বত্য রাঙামাটিবাসিকে সইতে বা দেখতে না হয়।
প্রিয় বাবা
আপাতত: সব খবরই জানালাম তোমায়। এবার আমাদের খবর বলি। তোমার স্বপ্নবাড়ির সদস্য তালিকায় যোগ হয়েছে জারিফ ও প্রার্থনা। ও তুমিতো তাদের চিনোই না,দেখোনি কোনদিন। খুকির ছোট ছেলেটার নাম জারিফ,সারাক্ষন সবাইকে ‘মামা মামা মামা…’ বলে ডাকা পিচ্ছিটা নাকি ঠিক তোমার কার্বনকপি,তাই খুকি ওকে আদর করে ডাকে ‘মোস্তফা সাহেব’। আর নান্টুর প্রথম সন্তান প্রার্থনা। দুষ্টটা যে কি সুন্দর করে খিলখিল করে হাসে….। কি দুর্ভাগ্য ওদের তোমার আদর ভালোবাসা কিংবা ছায়া পায়নি এই দুই দেবশিশু। তুমিও কোনদিন শুনলেনা ‘দাদু..’ডাক। অবশ্য তোমার অনুপস্থিতির অপূর্ণতা পূর্ণ করে দিচ্ছে আমার মা। তোমার ছোট ছেলে নান্টু সুপ্রীম কোর্টের নিবন্ধন পেয়ে এখন ব্যস্ত আইনজীবি,মিন্টুর ব্যবসাও সম্প্রসারিত তেল ও গ্যাসে। খুকি ব্যস্ত শিক্ষকতায়,এ্যানি পড়াশুনা শেষ করে এ বছরই বাসায় ফিরেছে। তোমার দুই ছেলের বউ সুমি আর কানিজ চাকুরি করছে ঢাকায়। আর মা দৃশ্যত ভালোই আছেন, প্রিয় মানুষের শোক আর স্মৃতি বুকে নিয়ে,সন্তানদের আগলে রেখে। ও আচ্ছা, তোমারতো আমার বন্ধুদের খবরও জানা চাই,তাই নাহ ? জসীম এখন উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা,সবুজ সময় টিভির সাংবাদিক,সোহেল আর বিপ্লব পৌরসভায় চাকুরি করে,রানা ব্যস্ত মুদি ব্যবসায়,নাজিম হোটেল খুলেছে বনরূপায়,জুয়েলও নিজের মেয়ের নামে দোকান খুলেছে। সবাই কমবেশি ভালোই আছে। চলতি পথে তোমার বন্ধু,সহকর্মীদের অনেকের সাথেই দেখা হয়,কেউবা হাসিমুখে এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করে,কেউবা উপেক্ষার চোখে চলে যান নিজের পথে। আমি কিছুই মনে করিনা,ঠেকে আর ঠকে তুমিহীন পৃথিবী অনেক কিছুই শিখিয়েছে আমায়।
ও বাবা, তোমাকে তো তোমার আমার কথাই বলা হলোনা ! আমি কেমন আছি ? জানিনা তো বাবা। তোমাকে হারানোর পর থেকেই বড় বেশি এলোমেলো তোমার বড়ছেলেটা আর কোনদিনই ছন্দে ফেরেনি। সারাদিন নিজের পত্রিকা,অনলাইনের নানা কাজ করা,সাংবাদিকতা আর ব্যবসার ব্যস্ততায় পৃথিবীর সবকিছু ভুলে থাকা ছেলেটা ভালোই আছে। মন খারাপ হলেই চলে যায় তোমার কবরের কাছে, একা একা কিছুক্ষণ কেঁদে কেটে ফিরে যায় ফের নিজের জীবনে। অসংখ্য পূর্ণতা,সফলতার মিশেলে এক অসাধারণ জীবন কাটানো ছেলেটা,বাবা হারানোর বেদনা বুকে নিয়েই বেঁচে আছে,থাকবে হয়তো আরো কিছু দিন,সব কাজ সেরে তোমার কাছেই ফিরবে বলে। তারপরই সব সফলতা-ব্যর্থতার কাহিনী শোনাবে তোমায়,হেরে যাওয়া কিংবা জিতে যাওয়ার সব গল্প শোনাবে তোমার কোলে মাথা রেখেই……সেই অবধি তুমি ভালো থেকো বাবা।
২০ সেপ্টেম্বর-২০১৭
রাঙামাটি