আমার দেখা পবিত্র এক শহর ‘বুখারা’

ফজলে এলাহী
জারফশান নদীর অববাহিকায় একটি বৃহৎ মরুভূমিতে অবস্থিত শহর ‘বুখারা’ তার গভীর-মূল ইতিহাসের পাশাপাশি এর আধ্যাত্মিক পরিবেশ দিয়ে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে বরাবরই। বুখারা তার গভীর-মূল ইতিহাসের পাশাপাশি এর আধ্যাত্মিক পরিবেশ দিয়ে নিমগ্ন রাখে তাকে দেখতে আসো লাখো কোটি মানুষকে। আপনি যখন অতীতের চিহ্ন বুকে আর চোখে নিয়ে এমন শহরের সড়ক ধরে হাঁটবেন, তখন ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশই থাকবে,আপনার হৃদয় জুড়ে। এই শহরকে আপনি সহজেই ‘মধ্যযুগের সবচে গুরুত্বপূর্ণ নগর’ হিসেবে অভিহিত করতেই পারবেন।

পারস্য সাম্রাজ্যের পবিত্র শহর এই ‘বুখারা’। এই শহরের পথচলা শুরু হয় খ্রীস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে। ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’র দখল করা শহরগুলোর এটিও একটি। ‘ইসলামের গম্বুজ’ শিরোনামের তিনটি শহরের মধ্যে একটি এই শহর।

বুখারা ইসলামের সাথে প্রাচীন ঐতিহ্যের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসকে মূর্ত করেছে। এটি জ্ঞান, পবিত্রতা এবং শিক্ষার একটি অবিশ্বাস্য পরিবেশের শহর। একবার আপনি এই শহরে গেলে মনে হবে আপনি অন্য জগতে, অন্য গ্রহে আছেন। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, জাতিগত সভ্যতার অবিশ্বাস্য সংমিশ্রণ বুখারাকে একটি অদম্য ছাপের শহর করে তুলেছে। বুখারা হল বৈজ্ঞানিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক জ্ঞানের ভান্ডার।

মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের অন্যান্য শহরের মতো, বুখারাতে তুর্কি-ইসলামী স্থাপত্যের সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন রয়েছে এর চমৎকার মসজিদ, উঁচু মিনার, নীল রঙের বিভিন্ন শেডের ক্যারাভান্সেরাই এবং টাইলস দিয়ে ঢাকা মাদ্রাসা, যারা বহু শতাব্দী ধরে ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে আসছে,যুগের পর যুগ,শতাব্দীর পর শতাব্দী, তারা আজও এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে।

বুখারা অঞ্চলে জরথুস্ট্রিয়ান, খ্রিস্টান, ইহুদি এবং বৌদ্ধরা বাস করত। ৯ম শতাব্দীর শেষে, বুখারা মধ্য এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। কয়েক শতাব্দী ধরে, ভ্রমণকারী, তীর্থযাত্রী, প্রচারক, গবেষকরা এখানে এসেছেন।

হাদিসশাস্ত্রের সম্রাট ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বুখারি (রহ.) জন্ম নিয়েছেন এই শহরেই। জগদ্বিখ্যাত বুখারি শরিফও সংকলন করেছেন তিনি এই শহরে বসেই। চিকিৎসাশাস্ত্রের পন্ডিত ইবনে সিনা ও বিখ্যাত সুফি বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.)-এর জন্মস্থানও এই শহর। ৯ম খ্রিস্টাব্দেই বহু শিল্পী, কবি ও বিজ্ঞানী বুখারায় ভিড় করেছিল। তখনকার এক প-িত বুখারাকে ‘সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মিলন স্থল, বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতির তারকা ব্যক্তিদের উত্থানের জায়গা এবং সময়ের কৃতি সন্তানদের সম্মেলন স্থল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

মধ্যযুগের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রগতিশীল লোকেরা এখানে বসবাস করতেন এবং অধ্যয়ন করতেন: আলিশার নাভোই, আবু আলী ইবনে সিনো (আভিসেনা), আল-বুখারি এবং আরও অনেকে সুফিবাদের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক শিক্ষার বিশিষ্ট অনুসারী ছিলেন। তাদের স্মৃতি রক্ষা করা হয়েছে এই মাটিতে। কল্পনাতীত সুন্দর মাদ্রাসা এবং মসজিদ তৈরি হয়েছে এই জনপদে।

১৩৩০ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাসের মহাপরিব্রাজক ইবনে বতুতা এই শহরে ভ্রমণ করেছিলেন,তখন তিনি এই শহরকে ‘বিশ্বের সুন্দরতম বৃহৎ শহর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

তৈমুর লংয়ের উত্থানের আগ পর্যন্ত চেঙ্গিস খানের উত্তরসুরিরাই বুখারা শাসন করত। মুসলমানদের প্রাণের এই শহরে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য ক্ষণজন্মা মুসলিম মনীষী। এখান থেকেই ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন তারা বিশ্বময়। একটা সময় বুখারা ছিল ইসলামী জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।

সারা বিশ্ব থেকে ছাত্ররা এখানে আসত দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণের জন্য। মধ্যযুগে বুখারায় অসংখ্য এমন মাদরাসা ছিল, যেখানে ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত ছাত্র পড়াশোনা করত। বুখারার কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা এত বিশাল ছিল যে সেখানে একসঙ্গে সহিহ বুখারির পাঠ নিত চার হাজারের মতো ছাত্র।

এই শহরের প্রাচীন স্থাপত্য, বিশাল প্রাসাদ, বাগানবীথি এবং নির্মাণশৈলী পর্যটকদের সহজেই মুগ্ধ ও মোহাবিষ্ট করেছে যুগে যুগে। প্রাচীন যুগ থেকেই নানা রাজবংশের শাসকদের পছন্দের শহর ছিলো এই বুখারা।

বুখারাতে ৩৫০টি মসজিদ ও ১০০টির বেশি মাদ্রাসা ছিলো। আর পুরাতন বুখারার প্রবেশপথে রাস্তার দুই দিকের স্থাপত্যগুলো মুসলিম-ঐতিহ্যের স্মৃতি ধরে রেখেছে। ৯৪ হিজরিতে নির্মিত একটি মসজিদ বুখারা নগরীতে এখনো রয়েছে। এছাড়াও বুখারাতে ১৫১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত কালান মসজিদ। আরো নির্মাণ হয়েছিল ইয়েমেনের অধিবাসী শেখ আবদুল্লাহ ইয়ামানির তৈরি মির-ই-আরাব মাদ্রাসাটি।

১৪০টি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে টিকে থাকা বুখারাকে বলা হয় ঈরঃু ড়ভ গঁংবঁস, যা ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যেরই অংশ। ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল বুখারা, ষষ্ঠ শতকে যা ছিল পৃথিবীর বাণিজ্যিক মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বণিজ্যিক কেন্দ্র।

পুরাণে বুখারা

বুখারাকে নিয়ে প্রচলিত আছে নানা পৌরানিক কাহিনী। ইরানের বিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামা অনুসারে, রাজা কায়কাউসের পুত্র সিয়াভাশ বুখারা প্রতিষ্ঠা করেছলেন। পুরাণ বলে, সিয়াভাশ তার সৎমায়ের শ্লীলতাহানীর অভিযোগে আগুনে নিক্ষিপ্ত হন। সেই সময়ে প্রচলিত প্রথা ছিল অভিযুক্তকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। যদি সে নির্দোষ হয় তাহলে বেঁচে যাবে। তো সিয়াভাশ আগুন থেকে বেঁচে গিয়ে আমুদরিয়া পার হয়ে তুরান চলে যান। সেখানে সমরকন্দের রাজা তার মেয়ে ফারানজিসের সাথে তার বিয়ে দেন এবং তাকে বুখারার মরুদ্যানে এক টুকরো রাজ্য প্রদান করেন। সিয়াভাশ সেখানে দুর্গ নির্মাণ করেন এবং একে ঘিরে প্রাচীর দেন । এভাবেই বুখারা শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।

বুখারার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পারস্য সাম্রাজ্যের একটি রাজ্য হিসেবে বুখারার পথচলা শুরু হয় সেই খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে। পরবর্তীতে এটি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের দখলে আসে। আরবদের অধিকারে এসে মুসলিম সভ্যতায় সমৃদ্ধ হওয়ার আগে বুখারায় দুটি ধর্মীয় আন্দোলন সংঘটিত হয়। একটি সাসানি সাম্রাজ্যের শাসনামলে ম্যানিকাশিনিজম, আরেকটি অ্যাসিরিয়ান চার্চ অব ইস্টের নেস্টেরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি। এই ঘটনাগুলোর সাক্ষী হিসেবে বেশকিছু কয়েন ও ক্রুশ পাওয়া গেছে বুখারায়। নবম শতাব্দীতে বুখারায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এটি সামানিদদের রাজধানীর মর্যাদা পায়। সামানিদদের স্বর্ণযুগে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বুখারা। ইমাম বুখারী এই সময়ে জন্মলাভ করেন। সামানিদরা ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি রাজবংশ কারাখানিদদের কাছে পরাজিত হয়। তারপর বুখারা খারেজম শাহের রাজ্যের অন্তর্গত হয়। ১২২০ সালে বুখারা শিকার হয় চেঙ্গিস খানের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের। পরে অবশ্য শহরটি পুনর্নির্মিত হয়। তৈমুর লংয়ের উত্থানের আগ পর্যন্ত চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরীরাই বুখারা শাসন করে। এরপর বুখারা পরিণত হয় শায়বানী শাসকদের রাজধানীতে। তারপর উত্থান ঘটে আমিরাত অব বুখারার। সর্বশেষ ১৫৯৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত বুখারা খানাতের রাজধানী মর্যাদায় শহরটি অধিষ্ঠিত ছিল। ১৯২০ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনে বুখারা খানাতের পতন ঘটলে শহরটি তার মর্যাদা হারায় এবং এসময় শহরটি বিপুল ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় রেড আর্মি আমিরাত অব বুখারা দখল করে নেয়।
এরপর আসে বুখারান পিপলস রিপাবলিকের যুগ। এই সময় বুখারা উজবেক সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের অঙ্গীভূত হয়। এরপর ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাগ হয়ে উজবেকিস্তান স্বাধীন হলে বুখরা হয় বুখারা প্রদেশের রাজধানী।

 

কি দেখবেন
শিল্প সাহিত্য ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ শহর বুখারায় দেখার আছে অনেক কিছুই। মোটামুটি প্রতিটি স্থাপনাই খুব কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় দুইদিনের সংক্ষিপ্ত সফরেই আপনি এই শহরটি কমবেশি দেখে ফেলতে পারবেন। যেসব স্থাপনা সহজেই আপনার মন কাড়বে তার মধ্যে রয়েছে-

আর্ক দূর্গ
বর্তমান বুখারার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এই দুর্গটি। মোটামুটি চতুর্ভূজ আকৃতির এই দুর্গ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বিস্তৃত। পঞ্চম শতকে এটি নির্মিত হয়। নির্মাণের পর থেকে ১৯২০ সালে রাশিয়ান আগ্রাসনের আগপর্যন্ত সুদীর্ঘকাল এটি টিকে ছিল। রেড আর্মি বোমা মেরে দুর্গের একটা বড় অংশ উড়িয়ে দিলেও আর্কের জৌলুস খুব একটা কমেনি। এখনো আর্ক দেখতে কম আকর্ষণীয় নয়। মজবুত প্রাচীরের ভেতর অবস্থিত শক্তিশালী এই দুর্গকে বলা হয় ‘শহরের ভেতরে শহর’। আর্ক মূলত বুখারার আমিরদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সুদৃশ্য এই স্থাপত্যের প্রবেশমুখেই রয়েছে একটি জামে মসজিদ। তারপর শুরু হয়েছে কোয়ার্টার।

কালয়ান মিনার
বুখারার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা পোই কালয়ান মসজিদ কমপ্লেক্সের একটি মিনার হচ্ছে কালয়ান মিনার। এটি তৈরি করেন কারাখানিদ শাসক মোহাম্মাদ আরসালান খান। রোদে শুকানো ইট দিয়ে তৈরি গোলাকৃতির এই মিনারটি উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গেছে। এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে পঁয়তাল্লিশ মিটার।
মিনারের অভ্যন্তরে রয়েছে উপরে ওঠার জন্য প্যাঁচানো সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গোলাকার গম্বুজ আচ্ছাদিত ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিত মুয়াজ্জিন। যুদ্ধের সময় ওয়াচ টাওয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো এটি। বিশ শতকে অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে মিনারের উপর থেকে ফেলে দেওয়া হতো বলে মিনারটি ‘মৃত্যু টাওয়ার’ হিসেবেও পরিচিত। এই মিনারটির ইতিহাসে সৌন্দর্য ও মৃত্যু অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে।

চার মিনার
চার মিনার বুখারার একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। এটি নির্মাণ করেন খলিফা নিয়াজ কুল। তিনি ছিলেন জানিদ রাজবংশের শাসক। মসজিদের নামানুসারে এখানে যথারীতি চারটি মিনার আছে, তবে আযান দেওয়ার জন্য মিনার হিসেবে ব্যবহৃত হয় না কোনোটাই। তবে নীল রঙের কাজ করা মিনারগুলো মসজিদের সৌন্দর্য যে বাড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কালান মসজিদ
কালান মসজিদ বুখারার অন্যতম সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। প্রত্মতাত্ত্বিক খনন থেকে জানা যায়, কারাখানিদ শাসনামলে এখানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তবে তা মঙ্গোলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়। পরে পঞ্চদশ শতকে এখানে ঐ মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদটি কালান মসজিদ নামে পরিচিত। কালান মসজিদের গঠন মধ্য এশিয়ার আর দশটা মসজিদের মতোই। মসজিদের সামনে রয়েছে চতুর্ভূজাকৃতির আঙিনা। রয়েছে পিলারনির্মিত গ্যালারি। মসজিদের উপরিভাগে রয়েছে কারুকাজ করা নীল মিনার।

মির-ই-আরব মাদ্রাসা
কারুকার্যমন্ডিত মির-ই-আরব মাদ্রাসা দুটি ঝকঝকে নীল গম্বুজে সজ্জিত মির-ই-আরব মাদ্রাসা বুখারার আরেকটি অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা। নীল মোজাইকের নকশা ও ক্যালিগ্রাফি;নান্দনিক এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ষোল শতকে। শায়বানী শাসকদের ধর্মীয় গুরু শায়খ আবদুল্লাহ ইয়েমেনীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মাদ্রাসার সাথে। মির-ই-আরব মাদ্রাসার চোখধাঁধানো নকশায় স্থান পেয়েছে মোজাইকের কাজ, জ্যামিতিক কারুকার্য এবং ক্যালিগ্রাফির পরিমিত ব্যবহার।

লাব-ই-হাউজ
প্রাচীন বুখারার পানির উৎস ছিল কিছু উন্মুক্ত পুকুর। পানি সহজলভ্য হলেও রোগজীবাণু ছড়ানোর জন্য পুকুরগুলোর কুখ্যাতি ছিল। এজন্য ১৯২০ এর দশকে প্রায় সবগুলো পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়। লাব-ই-হাউজ বেঁচে যায় এর তিনপাশে তিনটি মনোহর স্থাপত্য থাকার কল্যাণে। পুকুরটির একপাশে আছে কুকেলদাশ মাদ্রাসা, নাদির দিওয়ানবাগী মাদ্রাসা ও নাদির দিওয়ানবাগী খানকা।

ইসমাঈল সামানির মাজার
ইসমাঈল সামানি মাজার বুখারার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। ইসমাঈল সামানি ছিলেন সামানিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইটের তৈরি ঘনকাকৃতির এই স্থাপনাটি মধ্য এশিয়ার প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন।

 

বুখারা সিনাগগ
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি সিনাগগ বা ইহুদি উপাসনালয়ের অবস্থান এই শহরে। চারশত বছরের পুরাতন এই সিনাগগটিকে কেন্দ্র করে বুখারাতে এখনও ছোট একটি ইহুদি সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। ঐতিহাসিক রেশম সড়কের কিনারে অবস্থিত বুখারা শহরটি সারাবিশ্বের পর্যটনপ্রিয় মানুষের কাছেই আকর্ষণীয় গন্তব্য।শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৯৩ সালে পুরাতন শহরটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সিনাগগের মাঝখানে, যে কোয়ার্টারে আজ কয়েকটি ইহুদি পরিবার বাস করে, সেখানে একটি উঠান, উঠানের উভয় পাশে বসার জায়াগা, একটি হানুক্কা, রাব্বিদের ফটো এবং খুব পুরানো তোরাহ রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে এখানে বসবাসকারী ইহুদিরা হাজার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ায় এসেছিল। যদিও এই ইহুদি সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ সদস্য পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তবুও অল্প সংখ্যক লোক এখনও উজবেকিস্তানে বাস করে এবং এটিকে তাদের বাড়ি বলে। সিনাগগ ছাড়াও শহরে একটি ইহুদি স্কুলও রয়েছে।

যা বলছে ইউনেস্কো
বুখারা শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যর অংশ ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। প্রতিষ্ঠানটি তার ওয়েবসাইটে এই শহর সম্পর্কে বলেছে-‘ সিল্ক রুটে অবস্থিত বুখারার বয়স ২,০০০ বছরেরও বেশি। এটি মধ্য এশিয়ার একটি মধ্যযুগীয় শহরের সবচেয়ে সম্পূর্ণ উদাহরণ, একটি শহুরে ফ্যাব্রিক যা অনেকাংশে অক্ষত রয়েছে। বিশেষ আগ্রহের স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে রয়েছে ইসমাইল সামানির বিখ্যাত সমাধি, ১০ম শতাব্দীর মুসলিম স্থাপত্যের একটি মাস্টারপিস এবং ১৭ শতকের অনেক মাদ্রাসা।”

‘ ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান এবং ১৩৭০ সালে তেমুরের মঙ্গোল আক্রমণের আগে থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বাদ দিয়ে, পুরানো শহরটি ১৬ শতকের প্রথম দিক থেকে উজবেক শাসনের শেবানি আমলের নগরবাদ এবং স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করে। ১৬ শতকে পুনঃনির্মিত দুর্গটি শহরের প্রারম্ভিক দিন থেকে বর্তমান পর্যন্ত শহরের নাগরিক কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’

কিভাবে বুখারা যাবেন

আপনি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ থেকে উজবেকিস্তান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এবং সমরখন্দ থেকে দ্রুত গতির ট্রেন (স্থানীয়ভাবে যা ‘আফ্রোশিয়া’ নামে পরিচিত) ব্যবহার করে ঐতিহাসিক শহর বুখারা পৌঁছাতে পারেন।

ট্রেন ভ্রমণের সময় যা প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা সময় নেয়, এই প্রাচীন শহরটি দেখার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অনেক পর্যটকের সাথে দেখা করা সম্ভব যেখানে হোটেলের মূল্য $৩০ থেকে $৬০ এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়। একজন ব্যক্তির পক্ষে $২ থেকে $৩ পর্যন্ত খাবার উপভোগ করাও সম্ভব। উজবেকিস্তান, মধ্য এশিয়ায় পর্যটনের জন্য অন্যতম পছন্দের দেশ, ২০১৬ সালের পর পর্যটনকে একটি “কৌশলগত খাত” হিসাবে নির্দিষ্ট করেছে তারা এবং তখন থেকেই এই ক্ষেত্রে তার বিনিয়োগের মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণ করছে সারা বিশে^র ভ্রমন পিপাসু মানুষের।

কাছাকাছি যেকোন প্রধান শহর থেকে বুখারা যাওয়ায় সবচেয়ে সহজ উপায় হল ট্রেন। তাসখন্দ থেকে, একটি দৈনিক উচ্চ-গতির ট্রেন রয়েছে যা প্রায় ৩.৫ ঘন্টা সময় নেয় এবং ট্রেন স্টেশনে কেনা হলে প্রায় ৭ ডলার খরচ হয়।

সমরকন্দ বা তাসখন্দ থেকে বুখারা পর্যন্ত দুই ধরনের ট্রেন আছে। উচ্চ-গতির ট্রেনটি প্রায় ১.৫ ঘন্টা সময়ে নেয় এবং ভাড়া কিছুটা বেশি, নিয়মিত ট্রেনটি প্রায় ২.৫ ঘন্টা সময় নেয় এবং দাম কিছুটা কম ।

কখন যাবেন
বসন্ত (মার্চ-মে) এবং শরৎ (সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর) মাসে সবচেয়ে হালকা আবহাওয়া থাকবে। গ্রীষ্মের মাসগুলি খুব গরম হতে পারে, যখন শীতের মাসগুলি খুব ঠান্ডা এবং তুষারময় হতে পারে।

কিছু পরামর্শ
বুখারা হাঁটার জন্য খুব বিখ্যাত ও দারুন শহর। এই শহরে কোন যানে না চড়েই আপনি পুরো শহর পায়ে হেঁটেই দেখে নিতে পারবেন। এবং এটাই সর্বোত্তম পন্থা। কিছুটা দূরের স্থাপনাগুলোর জন্য টেক্সি নিতে পারেন। স্থানীয় খাবার খাবেন,কার্ডে পেমেন্ট করতে পারবেন সহজেই। যেহেতু এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর প্রায় সবগুলোই ধর্মীয়,তাই শালীন পোশাক পড়াই শ্রেয়,হাঁটু ঢেকে রাখা পোষাকই ভালো। শহরটি খুবই নিরাপদ,অপরাধের মাত্রা নিতান্তই নগণ্য। লোকজন খুবই সহযোগিতাপূর্ণ আচরন করবেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে যেকোন হোটেলে বুকিং নিবেন,তাহলে সহজেই ঘুরে দেখা যাবে সব কিছুই।

বুখারা বহু শতাব্দী ধরে এক বিজয়ীর হাত থেকে অন্য বিজয়ীর কাছে চলে গেছে। বুখারার প্রতিটি বাসিন্দা তার শাসকদের পুরোপুরিভাবে স্মরণ করে এবং জানে। বুখারার পথে ঘাটে,ধুলোবালিতে যেনো মিশে আছে পেছনে ফেলা আসা গৌরবোজ্বল সব ইতিহাস, বাতাসে যেনো ভেসে বেড়াচ্ছে ঈমাম বুখারি,ইবনে সিনা কিংবা নকশবন্দী’র নিঃশ্বাস !

 

(নোট : লেখায় ব্যবহৃত তথ্য বিভিন্ন দেশী বিদেশী পত্রিকা,ওয়েবসাইট ও ভ্রমনকালিন সময়ে সংগ্রহ করা ব্রোশিয়র থেকে নেয়া, লেখার সব ছবি লেখকের নিজের তোলা)

Check Also

বাড়ীর পাশে আরশীনগর : চেনা রেঙ্গুন-অচেনা ইয়াংগুন

সিদ্ধান্তটা সাহসীই ছিলো বৈকি, দুই প্রতিবেশী দেশের বৈরিতা আর ঘৃণার বাতাস যখন বেশ প্রবলভাবেই বহমান, …

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × one =